ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি হয় ফর্সা হবার ক্রিম মাখলে

বিয়ের দিন আমাকে সত্যিই! খুব বাজে লাগছিল। এতটা বাজে আর কখনোই দেখায়নি। আবেগঘন কণ্ঠে একথা বললেন,সাদিয়া সুলতানা। না এটি তার আসল নাম নয় সামাজিক কারণে তার আসল নামটা প্রকাশ করলাম না ২১ বছর বয়সী সুমাইয়া থাকেন ঢাকার নামকরা এক অভিজাত এলাকায়।২০২০ সালের কথা নিজের বিয়ের আগে জান্নাত চেয়েছিলেন,গায়ের রং ফর্সা করতে শুধু তিনি নন তাঁর মতো দক্ষিণ এশিয়ায় আরো অনেক নারীই তাদের গায়ের রং উজ্জল করতে মরিয়া যেন সাদা চামড়া না থাকলে জীবনটাই বৃথা। বিয়ের মাস দুয়েক আগে আমি একটা সেলুনে গিয়েছিলাম রং ফর্সা করার জন্য।তারা আমাকে একটা ক্রিম দেয় দুই সপ্তাহ ব্যবহার করার পর দেখলাম আমার মুখ জ্বলে গেছে।

ছবি:সংগৃহীত 

আমি চেয়েছিলাম ত্বক ফর্সা করতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পড়ে গেল প্রথমে মুখে সাদা রঙের ছবি দেখা দেয় পরে তা কালো দাগের উপর সে পুরো ঘটনার সারাংশ এটাই তার যখন বিয়ের কেনাকাটা করার কথা অনুষ্ঠানে কারা কারা অতিথি হয়ে আসবেন সেদিকে নজর দেবার কথা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তখন তাকে নামতে হয় ত্বকের চিকিৎসায় এর পেছনে টাকা খরচ হয় কিন্তু বিধিবাম এক বছর ধরে চিকিৎসার পরও আফেয়ার গলার সেই কালো দাগ এখনো রয়ে গেছে মূলত সেলুন থেকে তাকে রঙ ফর্সাকারী ক্রিম দেওয়া হয়েছিল ।


সেটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কোন প্রসাধনী সামগ্রী ছিলনা অবৈধভাবে আমদানি করে কালোবাজারে বিক্রি করা হচ্ছিল তিনি কিন্তু এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই নয় এশিয়া এবং আফ্রিকাতে লাখ লাখ মানুষ যাদের বেশিরভাগই নারী প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছে একের পর এক রংপুর সরকারি প্রডাক নিজেদের অজান্তেই ডেকে আনছেন সর্বনাশ ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে গায়ের রং ফর্সা করার এই ইন্ডাস্ট্রির আকার ছিল প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ধারণা করা হচ্ছে ২০২৭ সালের মধ্যে এই বাজার প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৯২ হাজার কোটি টাকায় রং ফর্সাকারী এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে সাবান ক্লিন ব্রাশ ট্যাবলেট এমনকি ইঞ্জেকশন এসব পণ্যের চাহিদা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী আফ্রিকাতে প্রতি দশজনে চারজন রঙ ফর্সাকারী পণ্য ব্যবহার করে থাকেন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নাইজেরিয়ায় সেখানে ৭৭ শতাংশ নারী এসব পণ্যের ভোক্তা তার পরেই রয়েছে সেখানকার ৫৯% আর দক্ষিণ আফ্রিকায় এই হার ৩৫ শতাংশ পাশের দেশ ভারতে একশটি শতাংশ ও চীনের ৪০ শতাংশ নারী এসব পণ্য ব্যবহার করে থাকেন।


 আর দিনে দিনে সব জিনিসের প্রতি ভোক্তাদের চাহিদা বেড়েই চলেছে এবার আসুন ফোনের সাইন স্টার ছোট্ট করে জেনে নেওয়া যাক এর পেছনে মূল যে উপাদানটি কাজ করে তা হল মেলানিন মেলানিন ততবেশি উজ্জ্বলতা উপরে নির্ভর করে আপনার চামড়ার উজ্জ্বলতার রাস বৃদ্ধি ক্রমাগত নাড়তে থাকুন মেলানিন বাড়তে থাকবে ত্বকের উজ্জ্বলতা ও কমতে থাকবে সমানতালে এ কারণে যতরকম স্কিন হোয়াইটনিং প্রোডাক্ট আমরা দেখি তার সব কিছুরই কাজ মূলত এই মেলানিন উৎপাদন কমানো ভিটামিন-সি হাইড্রোকুইনন আর এক্ষেত্রে ভালো কাজ করে এর মধ্যে পারবি আর বাকিগুলো যে ত্বকের জন্য খুব ভালো জিনিস তা কিন্তু নয় অথচ স্কিন লাইটনিং প্রোডাক্ট গুলোতে এসবের দেখা মেলে হরহামেশাই আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারীরা চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়া এসব ক্ষতিকর কসমেটিক ব্যবহার করা শুরু করে দেয় ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন বলছে হাইড্রোকুইনোন আছে।

 

এরকম প্রসাধনী পণ্য একজন স্কিন কেয়ার স্পেশালিস্টের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান নিরাপদে ব্যবহার করা যেতে পারে যেসব স্থানে কালো দাগ পড়ে গেছে সেগুলো এর মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় এবং তাতে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব কিন্তু তা করতে হবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বাস্তবে তার করা হয় এর ফলাফল গুরুতর পার্শপ্রতিক্রিয়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মার্কারি যুক্ত সাবান ও ক্রিম ব্যবহারে যেসব ক্ষতি হয় তার মধ্যে রয়েছে কিডনির ক্ষতি ত্বকে ফুসকুড়ি হওয়া রং বদলে যাওয়া কালসিটে দাগ পড়া ব্যাকটেরিয়াও ফাংগাল সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যাওয়া উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিষন্নতা মানসিক অস্থিরতা থেকে বৈকল্য স্নায়ুজনিত সমস্যা মোটকথা সমস্যার যেন কোন শেষ নেই এমনকি প্রাণঘাতী ক্যান্সারও হতে পারে কিন্তু তাতে কি চিনেন লেবানন মেক্সিকো পাকিস্তান ফিলিপিন থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে উৎপাদিত হচ্ছে মাটিযুক্ত প্রসাধনী পণ্যের ক্রেতা আমি আপনি আমাদের পরিবার পরিজন সবাই।


 এভাবে শুধুমাত্র একটু ফর্সা হবার মোহে নিজেদের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজাচ্ছি আমরা অথচ ব্রিটিশ স্কিন ফাউন্ডেশন এর মুখপাত্র আলেক্সান্দ্র কি বলেছেন শুনুন ফর্সা করার নিরাপদ কোন উপায় নেই দোকানে যেসব সিম পাওয়া যায় সেগুলো যে আসলেই গায়ের রং ফর্সা করে এমন কোন প্রমান নেই বরং এর উল্টো ফল হতে পারে এই ক্রিম আপনার ত্বককে অস্বাভাবিক রকমের সাদা করে দিতে পারে কিংবা আরো কালো করে দিতে পারে এর ফলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে ত্বকের স্বাভাবিক গুণাবলী ও আমার মত কিছু কিছু সমস্যার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা রঙ ফর্সাকারী প্রেসক্রাইব করে থাকেন বটে কিন্তু এক্সেপশন তো আর এক্সাম্পল হতে পারেনা নিজে ফর্সা হতে চাওয়ার ব্যাপারটা তাও মেনে নেওয়া যায়।

 

 কিন্তু ঘানার নারীরা এই জিনিসটাকে আরও এক কাঠি উপরে নিয়ে গেছে কিছুদিন আগেও সেখানকার গর্ভবতী নারীরা এক ধরনের রঙ ফর্সাকারী ট্যাবলেট খেতে তাদের ধারনা এই ট্যাবলেট খেলে গর্ভের সন্তানের গায়ের রং ফর্সা হবে তবে শেষমেশ থানার কর্তৃপক্ষ গর্ভবতী নারীদের সতর্ক করে দেয় রং ফর্সাকারী ট্যাবলেট না খাওয়ার জন্য কারণ এসব ট্যাবলেটে পাওয়া গেছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্লুটাথিওন জামা ও শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর শুধু ট্যাবলেট হাল আমলে স্কিন ব্লিচিং এর যে জব শুরু হয়েছে তাতেও ব্যবহার করা হয় এই ক্ষতিকারক গ্লুটাথিওন এর ঝুঁকি অনেক স্কিন ব্লিচিং দিয়ে ফর্সা হতে গিয়ে লেখার শুরুর দিকে গল্পে রাশিয়ার মতো নিজের লোকের দফারফা করে ফেলেছেন এমন নজিরও কম নয় লাইটক্যাসল পার্টনার্স এবং এ লাইট মার্কেট রিসার্চ এর মত গবেষণা সংস্থা গুলোর ভাষ্যমতে।

 


বাংলাদেশ স্কিন কেয়ার পার্সোনাল কেয়ার শিল্পের আনুমানিক বাজারের আকার ২০২০ সালে ছিল ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি।আমাদের দেশেও এসব প্রোডাক্ট তুমুল জনপ্রিয় কিন্তু কেন চামড়া সাদা করতে কেন এত আয়োজন আসলে ব্যাপারটা অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক ভারতে প্রতি ১০ জন নারীর ৮ জন বিশ্বাস করে গায়ের রং ফর্সা হলে সামাজিকভাবে অনেক সুবিধা পাওয়া যায় আর তাদের এই ধারণা কিন্তু অমূলক নয় আপনি যদি শ্যাম বর্ণের হয় জীবনে একবার হলেও গায়ের রং নিয়ে হেনস্থার শিকার কি হননি কিংবা ফর্সা নয় এমন কাউকে কালু কাইল্লা নিগ্রো বলে সম্বধিত হতে দেখেননি বিয়ের সময় ফর্সা চামড়ার পাত্র-পাত্রী আলাদা কদর কি পায়না আলবাত পায় তার ওপরে শত বছর ধরে আমাদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছে সাদা চামড়ার ।


ইউরোপিয়ানরা তার আগে আফগানরা এ কারণে সাদা চামড়া কে আভিজাত্যের আর গৌরবের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে যুগ যুগ ধরে যা আজও বদলায়নি আজও পশ্চিমা হালচাল এর প্রতি আমাদের বেসামাল তার অবচেতন মনে নিজের বাদামি খোলস পাল্টে তাদের মতো ফর্সা হতে চাও তো স্বাভাবিক অনেকে আবার এসব প্রসাধনী পণ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে সিনেমা নাটকের মতো বিনোদন শিল্প কে দায়ী করে থাকেন কারণ এসব ইন্ডাস্ট্রিতে বিশেষ করে শারীরিক কাঠামো ও ত্বকের রঙের উপরে জোর দেওয়া হয় পর্দায় দেখা নাইকা-মডেলের উজ্জ্বল চেহারা দেখে তার মত হবার চেষ্টায় নামে নারীরা আর এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে লাখ নারীর স্বাস্থ্য সেইসাথে সমাজে কালো চোখে দেখা সিংহভাগ পুরুষের উজ্জ্বল বর্ণের নারীদের প্রতি আসক্তি ইত্যাদি নানা কারণ নারীদেরকে বাধ্য করে ফর্সা হবার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে এই প্রতিযোগিতার ইতি টানা প্রয়োজন আর তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা প্রচেষ্টা থেমে নেই গায়ের রং ফর্সা হতে হবে এমন মানসিকতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন।

 

যার সর্বশেষ উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ফ্লয়েড কে হত্যার পর বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে সারা বিশ্ব এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি ও ক্রিস গেইল অভিযোগ তুলেছিলেন তারাও বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন বহুবার ড্যারেন সামির সমালোচনা সহ নানাবিধ সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রঙ ফর্সাকারী ক্রিম হিসেবে বহুল পরিচিত ফেয়ার এন্ড লাভলী তাদের ব্র্যান্ড নেম পরিবর্তন করে গ্লো অ্যান্ড লাভলি রাখতে বাধ্য হয় প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে রাঘববোয়াল কোম্পানিগুলো সুন্দরের নামে গায়ের রঙ ফর্সাকারী ক্ষতিকর প্রসাধনী বিক্রি বন্ধের কথা বললেও বরাবরই তার রূপ পাল্টায় তাদের পণ্য বিক্রি করেছে নানা বাহারি নামে এদের ইতি টানতে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা আমাদের সচেতনতাই পারে তাদের এহেন জঘন্য চেষ্টাকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে সুন্দর মানেই যে ফর্সা নয় আমরাই পারি একথা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে ।


Next Post Previous Post